
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় একের পর এক মৃত্যুর খবর ভেসে আসছিল, ছোট্ট শহরটির অলিগলিতে শোক সংবাদ, শোক সংবাদ বলে কিছুক্ষণ পরপর মাইকিং হচ্ছিল। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা হাতীবান্ধা শহর-বন্দর এবং আশেপাশের এলাকাগুলো যেন শুনশান জনপদে পরিণত হচ্ছিল। এখানকার মানুষগুলো আচমকা আতঙ্কে যেন কাঁদতে ভুলে গেছে, ভয়ার্ত চোখে নিঃশব্দে মানুষজন হাতীবান্ধা ছেড়ে অন্যত্র পালানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শুধুমাত্র সচেতনার অভাবে নিপাহ ভাইরাস ট্রাজেডিতে প্রাণ হারায় ২৪ জন। দীর্ঘ ১২ বছর পরে ২০১১ সালের সেই ফেব্রুয়ারি মাস- আবারো ফিরে এলেও ঐসব প্রাণ হানির কথা আজও ভূলেননি এলাকাবাসী।
ঐ নিপা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছিলো সবার প্রাণ প্রিয় অবুঝ শিশু, যুবক, সদ্য বিবাহীত য্বুকসহ মহিলাদেরকেও। আপনজনদের হাড়ানোর ব্যথায় আজও ব্যথিত স্বজনেরা।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় ২০১১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি এইদিন থেকে নিপাহ ট্রাজেডিতে একে একে ২৪ জন মারা যান। দীর্ঘ দশ বছর পরেও এসব প্রাণহানির কথা আজও ভুলেননি হাতীবান্ধার বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষজন। শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে দীর্ঘ ওই মরদেহের মিছিলে যুক্ত হয়েছিল অবুঝ শিশু, সদ্য বিবাহিত যুবক ও নারীরা। তাই আপনজনদের হারানোর ব্যাথা আজও তাদের তাড়া করছে স্বজনদের। জানা গেছে, ২০১১ সালের এই দিনে হঠাৎ করে দেখা যায় অজানা ‘জ্বর’। জ্বরে সংক্রামিত হওয়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে আক্রান্তরা ঢলে পড়তে থাকেন মৃত্যুর কোলে। পরে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নীরাক্ষা করে জানান এটি আসলে এনকেফালাইটিস। যা নিপাহ ভাইরাস হিসেবে পরিচিত। ভাইরাসটি বাঁদুড় থেকে ছড়িয়েছে। খেজুড়ের রস খেয়ে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণে কয়েকদিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শিশু, নারীসহ বিভিন্ন বয়সী অন্তত ২৪ জন প্রাণ হারান। যদিও সরকারিভাবে এ মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ জন বলে দাবি করা হয়।
হাতীবান্ধা মেডিকেল মোড়স্থ চাতাল ও তামাক ব্যবসায়ী আব্বাস মিয়ার বড় ছেলে সবার প্রিয় আব্দুর রাজ্জাক, একই এলাকার কাঁচামাল ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নানের বড় ছেলে আব্দুর করিমের তরতাজা দুটি প্রান্ত কেড়ে নেয়, সেই নিপা ভাইরাস।
আজও ভুলতে পারিনা হাতীবান্ধা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন স্কুল শিক্ষক অশোক ঘোষ-তাপসী ঘোষ দম্পতি সেই ট্রাজেডির দৃশ্য। এ দম্পত্তির এক ছেলে অরন্য (সম্ভবত চতুর্থ শ্রেনী) ও অনন্যা (শিশু শ্রেনীর শিক্ষার্থী) নামের একটি মেয়ে ছিল। ফুটফুটে এ শিশু দুটি নিপাহ ভাইরাসের শিকার হয়ে একদিনের ব্যবধানে মৃত্যু মুখে ঢলে পড়ে।
অপরদিকে, একই অবস্থা বিরাজ করছে দক্ষিণ গড্ডিমারী গ্রামের কাজী জাহাঙ্গীরের পরিবারেও। তিনিও এই ঘাতক ভাইরাসে হারিয়েছিলেন তার ছোট্টা দুই মেয়ে জয়ী ও সর্বাকে। শুধু ওই অবুঝ শিশুরাই নয় হাতের মেহেদির রঙ শুকানোর আগে হতভাগিনী লিপি বেগম হারিয়েছে তার স্বামীকে। বিয়ের ১১ মাস পর ওই নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ছেড়ে চির বিদায় নেন আজিজুল (২৭)। কিছুদিন পর লিপির কোলে ফুটফুটে এক শিশুর জন্ম হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাবা নামক সেই প্রিয় ডাক অধরাই থেকে গেল তার। সূত্র মতে, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাতীবান্ধায় আসা রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞ দল জানিয়েছিলেন, যেহেতু নিপা ভাইরাসের বাহক বাঁদুড় তাই কোনো এলাকায় একবার এ রোগ দেখা দিলে পরবর্তী কয়েকটি বছর শীতের মৌসুমে রোগটি পুনরায় ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতাই এই ঘাতক নিপা থেকে রক্ষার একমাত্র পথ বলে জানান বিশেষজ্ঞ দলটি। সেই থেকে পরবর্তী বছরগুলোতেও বেশ প্রচার-প্রচারণা হওয়ায় জনসাধারণ মোটামুটি সর্তক হয়ে উঠেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু এ বছর স্বাস্থ্য সচেতনতায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রচার-প্রচারণা লক্ষ করা যায়নি।